নিজ
কাজের জন্য পদ্মশ্রী পুরস্কারে ভূষিত কল্পনা সরোজ। বর্তমানে তিনি ১১২
মিলিয়ন ডলার সম্পন্ন প্রতিষ্ঠানের চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার (সিইও)। অথচ তিনি
বাল্য বিয়ের শিকার হয়েছিলেন। দরিদ্র পরিবারে জন্মানো এই নারী ভারতের
অন্যতম সফল এক উদ্যোক্তা। তিনি মনে করেন, আইভি লিগ ড্রিগ্রি অথবা এমবিএ
ডিগ্রি কখনোই একজন উদ্যোক্তা তৈরি করতে পারে না। সংকল্প, অধ্যাবসায় এবং
প্রবল আগ্রহ থাকলেই একজন মানুষ সফল উদ্যোক্তা হতে পারেন। সম্প্রতি কল্পনা
সরোজের জীবন নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে
রেডিফ ডটকম। কল্পনার মুখেই তাঁর জীবন সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক।
শিশুকাল
আমি ভারতের ভিদরবাহতে জন্মগ্রহণ করি। আমার বাবা একজন পুলিশের কনস্টেবল
ছিলেন এবং আমরা পুলিশ কোয়ার্টারেই থাকতাম। আমরা তিন বোন এবং দুই ভাই। আমি
স্কুলকে খুব ভালবাসতাম এবং ছাত্রী হিসেবেও খুব ভাল ছিলাম। আমরা যে
কোয়ার্টারে থাকতাম সেখানে আমাকে অন্য শিশুদের সাথে খেলাধুলা করতে দেয়া হতো
না। এটা অবশ্য সেখানকার অভিভাবকদের জন্যই হতো। আমি যদি আমার বয়সী শিশুদের
খেলার জন্য ডাকতাম তাহলে তাদের অভিভাবকরা খুব রাগ করতেন। এমনকি স্কুলেও
আমার সাথে এরকমটিই ঘটত। শিক্ষকরা অন্য শিক্ষার্থীদের থেকে আমাকে বিরত রাখতো
এবং আমাকে শিক্ষা বর্হিভূত ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে
দেয়া হতো না। সপ্তম শ্রেনীতে পড়া অবস্থায় আমার স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেয়া
হয় এবং বিয়ে দিয়ে দেয়া হয়।
বল্যবিবাহের শিকার
আমার বাবা খুব বেশি শিক্ষিত ব্যক্তি ছিলেন না। কিন্তু তিনি চেয়েছিলেন
আমাকে পড়াশুনা করাতে। আমরা যেখানে থাকতাম সেখানে বাল্য বিবাহ সাধারণ বিষয়।
ওই স্থানের লোকজনদের চাপে আমার বাবা আমাকে বিয়ে দিতে বাধ্য হন।
বিয়ের পরের জীবন
আমি যে সমাজে বেড়ে উঠি, সেখানে বিয়ে পরবর্তী জীবন খুব সহজ নয়। আমি
দাসত্বকে মেনে নিয়েছিলাম, কারণ আমি জানতাম বিয়ে পরবর্তী জীবন সম্পর্কে।
কিন্তু সবকিছু মেনে নেওয়ার পরও আমাকে অত্যাচারিত হতে হয়েছে। আমার বয়স তখন
১২ এবং এ বয়সেই আমাকে রান্না, পরিস্কার- পরিচ্ছন্নতা এবং কাপড় ধোঁয়াসহ
বাড়ির ১০ জন লোকের কাজ করে দিতে হতো। তারা আমাকে অনাহারে রাখত এবং মানসিক ও
শারীরিকভাবে নির্যাতন করত। বিয়ের ছয় মাস পরে যখন আমার বাবা আমকে দেখতে
আসেন তখন তিনি বলেছিলেন, আমি একটি মৃতদেহ দেখতে পাচ্ছি আমার মেয়েকে নয়।
ঘৃণার অধ্যায়
আমার বাবা আমাকে বাড়িতে নিয়ে আসেন কিন্তু সমাজের লোকজন সবসময় আমার দিকে
ঘৃনার দৃষ্টিতে তাকাতো। আমাদের সমাজে মেয়েদের বিয়ের পর বাবার বাড়িতে
অবস্থানকে অত্যন্ত ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখা হতো। আমি আমার সকল দায়িত্বকে বাবার
উপর দিতে চাচ্ছিলাম না। আমি মহিলা কনস্টেবল পদ, বাচ্চাদের স্কুল এবং
সেনাবাহিনীতে যোগদানের আবেদন করি। কিন্তু আমার শিক্ষাগত যোগ্যতা কম থাকায়
তারা আমাকে নেয়নি। এরপর আমি বাড়িতে বসে দর্জির কাজ শুরু করি। আমি দশ রুপিতে
ব্লাউজ সেলাই করতে থাকি। এতেও সমাজের লোকেরা আমার উপর থেকে ঘৃণার দৃষ্টি
ফিরিয়ে নেয়নি।
দ্বিতীয় সুযোগ
বেঁচে থাকা কঠিন, কিন্তু মরে যাওয়া সহজ। আমি ঠিক এরকমটিই ভেবেছিলাম বিষ
পান করার আগ মুহূর্তে। আমার চাচি আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যান। ডাক্তাররা আমার
জীবন নিয়ে খুব শঙ্কিত ছিলেন। তারা আমার বাব-মা’কে বলেছিলেন, ১২ ঘন্টার
মধ্যে আমার জ্ঞান না থাকলে আমার বেঁচে থাকার আর কোনো সম্ভাবনা নেই। আমি
বুঝিনি কেন আমি মারা গেলাম না। আমি যখন চোখ খুলি, তখন আমি নিজেকে আর ঘৃণার
পাত্র হিসেবে ভাবিনি। আমি নিজের মধ্যে শক্তি অনুভব করলাম। আমি দ্বিতীয় একটি
সুযোগ পেয়েছিলাম এবং জীবনকে নষ্ট করতে চাচ্ছিলাম না।
নতুন জীবন
আমি আমার বাব-মা’কে বুঝিয়ে মুম্বাইতে আমার চাচার বাড়িতে চলে যাই। এর
কিছুদিন পরই আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় আমার বাবা চাকরি হারান। আমি পরিবারের বড়
মেয়ে ছিলাম এবং পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী। আমি ৪০ রুপিতে একটি ঘর
ভাড়া করি এবং সেখানে আমার পরিবারের সদস্যরা যোগদান করেন।
আমার উদ্যোক্তা হওয়ার রহস্য
এক সময় টাকা আমাদের কাছে খুব বড় প্রয়োজন হয়ে দাঁড়ায়। আমার ছোট বোন
অসুস্থ্ হয়ে পড়ে এবং আমাদের কাছে তার চিকিৎসার জন্য পর্যাপ্ত টাকা ছিল না।
সে বলেছিল- দিদি আমাকে বাঁচাও, আমি মরতে চাই না। কিন্তু আমি তাকে কোনো
সাহায্য করতে পারছিলাম না। তার বাক্যগুলো মনে পড়লে আজও আমি শিউড়ে উঠি। তখন
আমি টাকার মূল্য বুঝতে পারি এবং আমি টাকা রোজগারের জন্য মরিয়া হয়ে উঠি। আমি
প্রতিদিন ১৬ ঘন্টা কাজ করতে থাকি এবং এখনো এ অভ্যাসটি রয়েছে।
শুরু
আমি বিভিন্ন জায়গাতে ঋণের জন্য আবেদন করি এবং ঋণের টাকা দিয়ে একটি ছোট
ফার্নিচারের ব্যবসা শুরু করি। উলহাস নগরের ওই ফার্নিচারের দোকানে আমি কম
দামের ফার্নিচার বিক্রি করতে শুরু করি। আমার ব্যবসা আস্তে আস্তে প্রসারিত
হতে থাকে। আমি একটি এনজিও খুলি যেখানকার সদস্যদের মধ্যে সরকারি ক্ষুদ্র ঋণ
নিয়ে কথা হতো। কারণ আমি চাচ্ছিলাম না কেউ আমার মতো কষ্ট করুক।
সুযোগ
ঋণ শোধ করতে আমার দুই বছর সময় লেগে যায় এবং আমার সামনে ব্যবসার নতুন
সুযোগ উন্মোচিত হয়। একবার আমি এক সুযোগ পাই একটি জমি ক্রয় করার। অনেক
ঝামেলার পর আমি জমিটি কিনতে পারি এবং সেখানেই আমার রিয়েল স্টেটের ব্যবসা
শুরু করি। আমি বুঝতে পারি জীবনের মোড় ঘুরে যাচ্ছে।
কামানি টিউবসের ঘটনা
রামজি ভাই কামানির মৃত্যুর পর কোম্পানির মালিকানা নিয়ে দ্বন্দ্বের এক
পর্যায়ে যখন প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ প্রায় তখন প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীরা আমার
কাছে আসে তাদের হয়ে কাজ করার অনুরোধ করতে। আমি শুরু করি।
যুদ্ধ
প্রতিষ্ঠানে যোগদানের পর আমি ১০ জনের একটি টিম তৈরি করি, যাদের
প্রত্যেকেই একটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে দক্ষ। এরপর আমি কয়েক জন পরামর্শদাতা
নিয়োগ দেই। তারা আমাকে পরামর্শ দেয় কীভাবে কোম্পানির ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা
সম্ভব। আমরা দুরবস্থা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হই এবং ২০০৬ সালে আমি প্রতিষ্ঠানের
চেয়ারম্যান নির্বাচিত হই। আদালত কামানি টিউবসের মালিকানা আমার উপর ন্যাস্ত
করে।
ভবিষ্যতের হাতছানি
রামজি কামানির মতো স্বপ্ন আমিও দেখতাম। তার স্বপ্ন ছিল কোম্পানিকে সারা
ভারতে প্রসারিত করা। আমি সেই স্বপ্ন অনুযায়ী কামানি টিউবসের নতুন দুটি শাখা
খুলি।
পরামর্শ
সফলতার জন্য পরিশ্রমের বিকল্প নেই। এক মনে উদ্দেশ পূরণের লক্ষে হেঁটে গেলে সফল হবেনই।